ভাষা শুদ্ধরূপে লিখতে হলে সে ভাষার বানান জানা খুব জরুরি। প্রত্যেক ভাষারই নিয়ম আছে। বাংলা ভাষার বানানেরও বিশেষ কিছু নিয়ম রয়েছে।
এই নিয়ম সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা আধুনিক করা হয়। বাংলাদেশে সাধারণভাবে মান্য করা হয় বাংলা একাডেমি অনুমোদিত বানানরীতি। নিচে বাংলা বানানের কয়েকটি সাধারণ নিয়ম দেখানো হলো।
বানানের কয়েকটি সাধারণ নিয়ম
ক. বানানে ই ঈ, উ ঊ- এর ব্যবহার
১। যেসব তৎসম শব্দের বানানে হ্রস্ব ও দীর্ঘ উভয় স্বর (ই ঈ, উ ঊ) অভিধানসিন্ধ, সে ক্ষেত্রে এবং অতসৎসম (তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র) শব্দের বানানে হ্রস্বস্বর (ই , উ ) হবে। যেমন:
তৎসম শব্দে:
অঙ্গুরি, অটবি, আবির, আশিস্, শ্রেণি, সারণি, পদবি, বিদেশি, তরি, দেশি, তরণি, ভ্রু।
অতৎসম শব্দে:
আদিম, আপিল, আমিন, আলমারি, উকিল, উর্দু, কারবারি, কারিগরি, কুমির, ধুলো, জরুরি, যিশু, লটারি, শিকারি, হাজি ইত্যাদি।
২। কয়েকটি স্ত্রী বাচক শব্দের শেষে ঈ-কার হবে। যেমন:-
অভিনেত্রী, কর্ত্রী, কল্যাণী, কিশোরী, গাভী, গুণবতী, শ্রীমতী, সতী, সরস্বতী, যুবতী, মাতামহী, পিশাচী, পত্নী, নারী, দুঃখিনী ইত্যাদি
৩। ভাষা ও জাতির নামের শেষে ই-কার হবে। যেমন: আফগানি, ইংরেজি, ইরাকি, ইরানি, ইহুদি, কাশ্মিরি, জাপানি, পাকিস্তানি, ফরাসি, বাঙালি, হিন্দি ইত্যাদি।
৪। বিশেষণবাচক ‘আলি’ প্রত্যয়যুক্ত শব্দে ই-কার হব্ যেমন: চৈতালি, পুবালি, বর্ণালি, মিতালি, মেয়েলি, রুপালি, সোনালি ইত্যাদি।
খ. বানানে ও-এর ব্যবহার
১। ক্রিয়াপদের বানানে পদান্তে ও-কার অপরিহার্য নয়। যেমন:
আনব, করত, খেলব, চলব, দেখত, ধরব, নাচব, পড়ব, বলত, মরব, লড়ব ইত্যাদি।
২। বর্তমান অনুজ্ঞার সামান্যরূপে পদান্তে ও-কার প্রদান করা যায়। যেমন: -
আনো, করো, খেলো, চলো, দেখো, ধরো, নাচো ইত্যাদি।
৩। ‘আনো’ প্রত্যয়ান্ত শব্দের শেষে ও –কার হবে। যেমন:
করানো, খাওয়ানো, ঠ্যাঙানো, দেখানো, নামানো, পাঠানো, শোয়ানো ইত্যাদি।
৪। অর্থ বা উচ্চারণ বিভ্রান্তির সুযোগ থাকলে কিছু বিশেষ্য, বিশেষণ ও অব্যয় শব্দে ও- কার দেওয়া আবশ্যক।
যেমন: কাল (সময়), কালো (কৃষ্ণ বর্ণ); কোন (কী, কে, কোনটি), কোনো (বহুর মধ্যে এক); ভাল (কপাল), ভালো (উত্তম)।
গ. বানানে বিসর্গঃ –এর ব্যবহার
১। পদান্তে বিসর্গঃ থকবে না। যেমন: ক্রমশ, দ্বিতীয়ত, প্রথমত, প্রধানত, বস্তুত, মূলত।
২। পদমধ্যস্থ বিসর্গ থাকবে। যেমন: অন্তঃস্থ, দুঃখ, দুঃসহ, নিঃশব্দ, পুনঃপুন, স্বতঃস্ফূর্ত।
৩। অভিধানসিন্ধ হলে পদমধ্যস্থ বিসর্গ বর্জনীয়। যেমন: দুস্থ, নিশ্বাস, নিস্পৃহ, বহিস্থ, মনস্থ।
ঘ. বানানে মূর্ধন্য-ণ ও দন্ত্য-ন-এর ব্যবহার
১। যুক্তব্যঞ্জনে (তৎসম শব্দে) ট-বর্গীয় বর্ণের (টঠডঢ) পূর্ববর্তী দন্ত্য-ন ধ্বনি মূর্ধন্য-ন হয়।যেমন: কণ্টক, ঘণ্টা, নির্ঘণ্ট, বণ্টন, অকুণ্ঠ, আকণ্ঠ, ভণ্ড, ভণ্ডামি, দণ্ড ইত্যাদি।
২। তৎসম শব্দে ঋ,ঋ-কার, র, র-ফলা, রেফ, ষ, ক্ষ – এর পর মূর্ধন্য-ণ হয়। যেমন/; ঋণ, তৃণ, অরণ্য, ত্রাণ, বর্ণ, বিদূষণ, বিশেষণ, ক্ষণ, ক্ষণিক।
৩। একই শব্দের মধ্যে ঋ,ঋ-কার, র, র-ফলা, রেফ, ষ, ক্ষ-এর যে কোনোটির পরে স্বরবর্ণ, ক-বর্গ, প-বর্গ এবং য়, য়, হ,ং- এই বর্ণগুলোর একটি বা একাধিক বর্ণ থাকলেও পরবর্তী ন-ধ্বনি মূর্ধন্য ণ হয়। যেমন:
কৃপণ, নিরূপণ, অগ্রহায়ন, অকর্মন্য, নির্বাণ, সর্বাঙ্গীণ, অপেক্ষমাণ, বক্ষমাণ।
৪। প্র, পরা, পরি, নির-এই চারটি উপসর্গের পর নম্, নশ্, নী, নু, অন্, হন্ প্রভৃতি ধাতুর দন্ত্য-ন স্থলে মূর্ধণ্য হয়। যেমন:
প্র: প্রণাম, প্রণব, প্রণীত, প্রণিপাত,
পরা: পরায়ণ, পরাহ্ন
পরি: পরিণতি, পরিণাম, পরিণয়
নির: নির্ণীত, নির্ণয়, নির্ণায়ক।
৫। যুক্তব্যঞ্জন গঠনে (অতৎসম শব্দে) ট-বর্গের পূর্বে দন্ত্য-ন হয়। যেমন:
ইন্টারম উইন্টারম কারেন্ট, গ্র্যান্ড, টেন্ডার, প্যান্ট, ব্যান্ড, লন্ডন, সেন্ট্রাল।
৬। যুক্তব্যঞ্জন গঠনে (তৎসম, অতৎসম সকল শব্দে) ত-বর্গের পূর্বে দন্ত-ন হয়্। যেমন: অনন্ত, অন্তরঙ্গ, একান্ত, ক্লান্ত, জ্বলন্ত, গ্রন্থ, পরান্ন।
৭। সন্ধি ও সমাসযোগে গঠিত শব্দের বানানে দন্ত্য-ন বহাল থাকে। যেমন: অগ্রনায়ক, অহর্নিশ, ক্ষুন্নিবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, দুর্নাম ইত্যাদি।
৮। তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি শব্দে সর্বত্র দন্ত্য-ন হবে। যেমন: আপন, আয়রন, কুর্নিশ, গ্রিন, ঝরনা, মেরুন ইত্যাদি।
ঙ. বানানে মূর্ধন্য –ষ-এর ব্যবহার
১। ঋ কিংবা ঋ-কার- এর পরে মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন: ঋষি, কৃষি, কৃষ্ণ, দৃষ্টি ইত্যাদি।
২। র-ধ্বনি রেফ – এর রূপ নিয়ে কোনো ব্যঞ্জনবর্ণের মাথায় বসলে ঐ ব্যঞ্জনের পর মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন: আকর্ষণ, ঈর্ষা, উৎকর্ষ, বর্ষা, বিমর্ষ, হর্ষ ইত্যাদি।
৩। অ, আ ছাড়া অন্য কোনো স্বরবর্ণ এবং ক, র বর্ণের পরবর্তী দন্ত্য-স মূর্ধন্য ষ হয় । যেমন: ঈষৎ, উষা, এষণা, কোষ, জিগীষা, বিষম, রোষ, সুষমা ইত্যাদি।
৪। ই-কারান্ত ও উ-কারান্ত উপসর্গের পর কতকগুলো ধাতুতে মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন: সঙ্গ>অনুসঙ্গ, সেক>অভিষেক, স্থান>অধিষ্ঠান, সুপ্ত>সুষুপ্ত।
৫। যুক্তব্যঞ্জন গঠনে (তৎসম শব্দে) ট-বর্গের পূর্বে মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন: অনিষ্ট, অষ্টম, আড়ষ্ট, উচ্ছিষ্ট, উপদেষ্টা, কষ্ট ইত্যাদি।
৬। যুক্তব্যঞ্জন গঠনে (তৎসম, অতৎসম সকল শব্দে) চ-বর্গের পূর্বে তালব্য-শ হয়। যেমন: আশ্চর্য, দুশ্চরিত্র, নিশ্চয়, পশ্চাৎ, প্রায়শ্চিত্ত, বৃশ্চিক, নিশ্ছিদ্র।
চ. বানানে রেফ – এর ব্যবহার।
রেফ- এর পর কোথাও (তৎসম, অতৎসম সকল শব্দে) ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না। যেমন: কর্জ, কর্ম,কার্য, পূর্ব, পর্দ, মর্মর, সূর্য ইত্যাদি।
ছ. বানানে ঙ/ং এর ব্যবহার
১। সন্ধিতে (তৎসম শব্দে) প্রথম পদের শেষে ম থাকলে ক-বর্গের পূর্বে ম স্থানে ং হবে। যেমন: অহংকার (অহম +কার); কিংকর, কিংবদন্তি, ভয়ংকর, সংকীর্ণ, সংগীত, সংঘ ইত্যাদি।
২। উপর্যুক্ত নিয়মে সন্ধিজাত না হলে, যুক্তব্যঞ্জনে ক-বর্গের পূর্বে ম্ স্থানে ঙ হব্ যেমন: আকাঙ্ক্ষা, অঙ্কুর, অঙ্গ, ইঙ্গিত, উচ্ছৃঙ্খল, পঙ্গু, শিক্ষাঙ্গন ইত্যাদি।
৩।প্রত্যয় ও বিভক্তিহীন শব্দের শেষে ং ব্যবহৃত হয়। যেমন: আড়ং, ইদানীং, এবং, ঠ্যাং, ঢং, পালং, ফড়িং ইত্যাদি।
৪। তবে অনুস্বারযুক্ত শব্দে প্রত্যয়, বিভক্তি বা স্বরবর্ণ যুক্ত হলে ং স্থলে ঙ লেখা হবে। যেমন: অড়ঙে, টঙে, ঢঙে, রাঙিয়ে।
প্রস্তুতকারী
বিজয় কুমার মন্ডল
সহকারী শিক্ষক
ফরিদপুর জেলা প্রশাসন স্কুল এন্ড কলেজ
No comments:
Post a Comment